ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান: মকবুল হোসাইন মজুমদার - Islamay Hazrat Abu Talib-er Abodan: Mokbul Hossain Mojumder

Out of stock

Quantity :

Out Of stock

সূচী
* ভূমিকা
* হযরত আবু তালিবের পরিচয়
* আব্দুল মোতালিবের দৃষ্টিতে হযরত আবু তালিব
* পবিত্র কাবার দায়িত্ব গ্রহণ ও আরবে হযরত আবু তালিবের প্রভাব
* ব্যবসায়ী আবু তালিব ও কিশোর নবী মোহাম্মদ (সা.)
* হযরত আবু তালিবের নিকট কাফের সর্দারদের অভিযোগ
* মোহাম্মদ (সা.) আবু তালিবের ইয়াতিম
* ইসলাম প্রচারের পূর্বে মোহাম্মদ (সা.)
* নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর বিবাহ পড়ান হযরত আবু তালিব
* আধ্যাত্মিক সাধনায় মোহাম্মদ (সা.)
* শেবে আবু তালিব-এ আশ্রয়
* অসুস্থ চাচার পাশে মোহাম্মদ (সা.)
* হযরত আবু তালিবের ম্যাইয়াতের গোসল ও জানাযার নামাজ পড়ান মহানবী (সা.)
* শাজারায় আবু তালিবই শাজারায়ে মোহাম্মদ (সা.)
* হযরত আবু তালিব-এর নামে বিভ্রান্তি প্রচারের কারণসমূহ
* হাদীসে দ্বাহদ্বাহ’র পর্যালোচনা
* প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা
* মুসলমানদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের কিছু আয়াত
* হাদীসে রাসূল (সা.)
* ‘জ্ঞান নগরীর দরজা’ হযরত আলীর কিছু বিখ্যাত উক্তি

ভূমিকা
মহান সৃষ্টিকর্তার নামেই শুরু করছি, পবিত্র কোরআনের মাধ্যমেই জানতে পেরেছি আল্লাহ পাকের মনোনীত দ্বীন হলো ‘ইসলাম’ । এই ইসলামকে যিনি সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব নবী-রাসূলগণের সর্দার হযরত মোহাম্মদ (সা.)। যে নবী (সা.)-এর আগমন না হলে আমরা মহান আল্লাহ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতাম না, জানতে পারতাম না কোরআন সম্পর্কে, জানতে পারতাম না দীন সম্পর্কে, এমনকি জানতে পারতাম না আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও। তাহলে বিষয়টি পরিস্কার যে, নবী (সা.) সমগ্র দুনিয়ার মানুষকে জাহেলী যুগের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে গেছেন। আর সেই জাহেলী ভাব যদি এখনো মুসলমানদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়, তবে কি আমরা ভেবে নেব যে, কোরআনের আলো যাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি তারা কি আজও অন্ধকারে নিমজ্জিত?

এমনই অসংখ্য অমিল অসংগতিপূর্ণ বিষয় বরাবরই আমাদের অন্তরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলছে। এসকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার জন্যই আমি বিভিন্ন সময়ে স্বনামধন্য আলেম-ওলামা ও বুজর্গগণের শ্মরণাপন্ন হয়েছিলাম। কিন্তু যথাযথ উত্তর না পাওয়ার কারণেই পবিত্র কোরআন, হাদীস ও ইসলামের ইতিহাসের গবেষণামূলক অধ্যয়নে রত হই। অতঃপর সত্য উন্মোচনে কিছু লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। যে প্রশ্নগুলো আমাকে সদা বিব্রত করত, তার কিছু অংশ পাঠকের উদ্দেশে বর্ণনা করছি। যেমন: পবিত্র হাদীস-আল-কিসায় নবীকন্যা ফাতেমা যাহ্রা (সা.আ.) থেকে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী বর্ণনা করেন। মহান আল্লাহ পাক বলেছেন: “যদি আমি মোহাম্মদকে সৃষ্টি না করতাম তবে এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মা- তথা কোনো কিছুই সৃষ্টি করতাম না।”

তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, নবী (সা.) না হলে তো আমরা আল্লাহর পরিচিতি, ইসলাম কিংবা মুসলমান-এর কোনটাই পেতাম না। তাহলে যিনি বা যাঁরা নবী (সা.)-কে লালন-পালন করেছেন, তারা তো ইসলামকেই লালন-পালন করেছেন। যাঁরা নবী (সা.)-কে আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁরা তো ইসলামকেই আশ্রয় দিয়েছেন। যারা নবী (সা.)-এর জন্য যুদ্ধ করেছেন, তাঁরা তো ইসলামের জন্যই যুদ্ধ করেছেন। আর যে মহিয়সী নারী নিজের সমস্ত ধন-সম্পদ নবী (সা.)-এর দ্বীন রক্ষায় বিলিয়ে দিয়েছেন, তিনি তো ইসলামকেই সাহায্য করেছেন এবং দ্বীন ইসলামকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই মহান প্রভু তাঁদের সেই অবদানের প্রতিদান দিতে ও কার্পণ্য করেননি। পবিত্র কোরআনের সুরা আদ-দ্বোহার ৬ ও ৮ নং আয়াতে ঐসকল মুমিন-মুমিনাতের কর্মের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাজকে প্রভু নিজের কর্ম হিসেবে প্রকাশ করেছেন। রব্বুল আলামীন বলছেন :
أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيماً فَآوَىٰ
وَوَجَدَكَ عَآئِلاً فَأَغْنَىٰ
“তিনি কি আপনাকে এতিম রূপে পাননি? অতঃপর আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব রূপে, অতঃপর অভাবমুক্ত করেছেন।”
যদি আমরা উল্লিখিত আয়াতসমূহের গভীরে প্রবেশ করি এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মিলিয়ে দেখি তবে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে নবী (সা.)-কে এতিম অবস্থায় আশ্রয় দিয়েছেন দুই মহান ব্যক্তি। একজন তাঁর দাদা আবদুল মোতালিব, অপরজন চাচা আবু তালিব। আর নিঃস্ব অবস্থায় অভাবমুক্ত করেছেন বিবি খাদীজাতুল কোবরা। এই তিন মুমিন-মুমিনার কর্মকা- এতোটাই প্রশংসনীয় যে, তাঁদের কৃতকর্মকে আল্লাহ পাক নিজ কর্ম বলে স্বীকৃতি প্রদান করছেন।
তাহলে মূল প্রসঙ্গে আসি, আমাদের সমাজের আলেম-ওলামা তাদের ওয়াজ-মাহফিল কিংবা তাদের লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন, “নবী (সা.)-এর চাচা হযরত আবু তালিব নাকি ঈমান আনেননি। নবী (সা.) বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি তিনি চাচাকে ঈমান আনার জন্য কানে কানেও আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু চাচা নাকি ঐ অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।” তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় ইসলামের জন্য যিনি অসংখ্য ত্যাগ-তিতীক্ষা ও অবদান রেখে গেছেন। তার পরেও কেন তাঁর বিরুদ্ধে এই প্রচার প্রচারণা। আর যারা তা করছেন তারাই বা কোন ইসলাম প্রচার করছেন?

তাই সেই মুহসিনে ইসলাম হযরত আবু তালিব, ইসলামের জন্য যে এহসান করেছেন তাঁর কিছু অংশ পাঠকের সামনে তুলে ধরছি। মহান খোদার একত্ববাদের প্রথম ঘোষণার সকল ব্যবস্থা হাশেমি বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র এই আবু তালিবই সর্বপ্রথম ‘দাওয়াত-এ-জুলআসিরা’-র মাধ্যমে সুসম্পন্ন করেছিলেন। সমগ্র আরবের কাফের সর্দারদের উত্তম আপ্যায়নের মাধ্যমে তিনি মোহাম্মদ (সা.)-এর খোদায়ী মিশন ও একত্ববাদের ঘোষণার সকল বন্দোবস্ত করেছিলেন। পরপর দুই দিন কাফের সর্দারেরা ভোজন শেষে চলে যায়। তৃতীয় দিন হয়রত আবু তালিব তরবারি উন্মুক্ত করে বলেছিলেন, “হে সর্দারগণ তোমরা প্রত্যেকেই যার যার অবস্থানে অপেক্ষা করো যতক্ষণ পর্যন্ত আমার ভাতিজা মোহাম্মদ তাঁর বক্তব্য শেষ না করে”। কাফেরেরা সেদিন আবু তালিবের নির্দেশ অমান্য করার সাহস পায়নি।

ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে ঐ দিনই আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রকাশ্যে জনসম্মুখে একত্ববাদের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “শোনো হে সর্দারগণ! আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয় তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি আমাদের ও তোমাদের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, তিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই। তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যেসকল দেব-দেবীর পূজা করছ তা তোমাদের কোনো কল্যাণে আসবে না। কোনো দেব-দেবী আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নয়। এগুলো তোমাদের বাব-দাদা ও পূর্বপুরুষদের সৃষ্টি। আল্লাহর সমকক্ষ কোনো শক্তিই নেই। তিনি সর্বশক্তিমান। আমি তার দাসদের অন্যতম। আর আজকের দিনে আল্লাহর কাজে যে আমাকে সাহায্য করবে সে হবে আমার ওয়াসী, আমার বন্ধু, আমার সাহায্যকারী ও আমার ভাই।” তখন উপস্থিত লোকজনের মধ্য থেকে হযরত আবু তালিবের কিশোর পুত্র হযরত আলীই নবী (সা.)-এর সাহায্যকারী হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করে দাঁড়িয়েছিলেন। নবী (সা.) তাঁকে বসার জন্য ইঙ্গিত করলেন। নবী (সা.) একই কথা তিনবার উচ্চারণ করে দেখতে চেয়েছিলেন কোরাইশ সর্দারদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সাহায্যকারী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন কি না? কিন্তু না ঐ তিনবারই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন হযরত আবু তালিবেরই সন্তান আট বছরের কিশোর আলী। আর ঐ সভাতেই নবী (সা.) তাঁর ওয়াসীর ঘোষণা প্রদান করেন, শুধু দুনিয়াতে নয় আখেরাতের জন্যেও।

পাঠকের অবগতির জন্য আরো কিছু বিষয় আমি তুলে ধরছি। শুধু যে হযরত আবু তালিব এবং তাঁর পুত্র আলী নবী (সা.)-কে ভালোবাসতেন তা কিন্তু নয়। হযরত আবু তালিবের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও নিকট আত্মীয়দের মধ্যে এমন কোনো সদস্য ছিলেন না যে, এক মুহূর্তের জন্যও মোহাম্মদ (সা.)-কে শত্রুদের সম্মুখে একা ছেড়ে গেছেন। এমনিভাবে হযরত আবু তালিব ও তাঁর পরিবার পরিজন ইসলামের নবী (সা.)-এর সাহায্যকারী ছিলেন মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত।

মক্কার কাফেরেরা যখন মোহাম্মদ (সা.)-কে লোভ-লালসা দেখানোর পরেও ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হলোনা এবং হাশেমিদের সাথে যুদ্ধেও মোকাবিলার সাহস পাচ্ছিল না। তখন তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করল। মোহাম্মদ (সা.)-কে আশ্রয়দানকারী হযরত আবু তালিব ও তাঁর পরিবার পরিজনদেরকে একঘরে করে দেয়ার নীতি অবলম্বন ও সমাজ থেকে তাঁদেরকে বয়কট করার ঘোষণা এবং কাবার দেয়ালে কাফের সর্দাররা তাদের স্বাক্ষরিত শপথপত্র ঝুলিয়ে দিল।

এমনসব প্রতিকূল পরিবেশ ও অবরোধ সত্ত্বেও হযরত আবু তালিব, মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর বিন্দুমাত্র আঁচড় যেন না আসে সে ব্যবস্থাই করেছিলেন। তিনি ভাতিজাকে নিয়ে সপরিবারে মক্কার অদূরে পাহাড়ের পাদদেশে একটি উপত্যকায় অবস্থান নিলেন। আর এই অবস্থার অবসান ঘটতে সময় লেগেছিল তিন বছরেরও অধিক সময়কাল। আবু তালিবের পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থানের ঐ স্থানটি আজও ইসলামের ইতিহাসে ‘শেবে আবু তালিব’ নামে পরিচিত।
হযরত আবু তালিব নবী (সা.) ও ইসলামের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণে সকল কাজের আন্জাম দিয়ে গেছেন। তদুপরি যেসব আলেম এই মহান ব্যক্তির সৎ কাজের স্বীকৃতির পরিবর্তে তাঁর ঈমান না আনার তির ছুঁড়ছেন। তারা কি হযরত আবু তালিবের এহসানের পরিবর্তে তাঁর প্রতি জুলুম করছেন না?
অথচ মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সূরা আর-রহমানের ৬০নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন :
هَلْ جَزَآءُ ٱلإِحْسَانِ إِلاَّ ٱلإِحْسَانُ
অর্থাৎ এহসানের প্রতিদানে এহসান ছাড়া আর কি হতে পারে?
উক্ত বইটিতে যে সকল ঐতিহাসিক বিষয়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার তথ্য সূত্র সমূহ সংখ্যা নির্ধারন পূর্বক বিভিন্ন পাতার নিম্নে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাদীসে দ্বাহদ্বাহ’র পর্যালোচনা
এটা সুস্পষ্ট হযরত আবু তালিব ঈমানদার ছিলেন। যেসব অন্যায় ও অবৈধ অপবাদ তাঁর ওপর আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বনী উমাইয়া ও বনী আব্বাসিদের কিছু শাসকের উস্কানিতে এসব অপবাদ প্রচার করা হয়েছে। বনী উমাইয়া ও বনী আব্বাসি শাসকরা সর্বদা মহান আহলে বাইত ও হযরত আবু তালিবের সন্তানদের সঙ্গে শত্রুতা করে এসেছেন।

তাই এ বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি। আর তা হলো- রাসূল (সা.)-এর একনিষ্ঠ সাথী হযরত আবু তালিবে’র ব্যক্তিত্ব খর্ব করার যে অপচেষ্টা শত্রুরা করেছিল সেটা হাদিসে “দ্বাহদ্বাহ” নামে পরিচিত। এই হাদিসটি পবিত্র কোরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নানা দলিলের আলোকে ভিত্তিহীন।
কিছু কিছু লেখক যেমন: সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে, ‘সুফিয়ান ইবনে সাঈদ সুরী’, ‘আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর’, ‘আব্দুল আযিয ইবনে মুহাম্মাদ দুরাওয়ারদী, এবং ‘লাইস ইবনে সাঈদ’ থেকে নিম্নোক্ত দু’টি কথা রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন;
ক. তাঁকে (আবু তালিবকে) আগুনের মধ্যে পেলাম অতঃপর তাকে দ্বাহদ্বাহ’তে স্থানান্তরিত করলাম। (আমার খাতিরেই তাকে আগুনের অগভীর অংশে আনা হয়েছে, তা না হলে তাকে আগুনের সবচেয়ে গভীর অংশে রাখা হত!)
খ. হয়তো বা কেয়ামতের দিন আমার শাফায়াত তাঁর (আবু তালিবের) কাজে আসবে। তাই তাকে জাহান্নামের আগুনের একটি অগভীর গর্তে রাখা হবে যে আগুনের উচ্চতা তাঁর পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছাবে। কিন্তু এতেই তার মগজ (টগবগ করে) ফুটতে থাকবে।” উল্লেখিত বর্ণনা দুটি কল্পনা প্রসূত ও আকল বিবর্জিত। কারন আগুন গভীর কিংবা অগভীর যাই হোক না কেন, এতে নিশ্চিত কোনো প্রশান্তি নেই, উপরোন্তু মগজ টগবগের বর্ণনা রয়েছে। আবার বলা হয়েছে, হয়তোবা অর্থাৎ নবী (সা.) তাঁর শাফায়াত সম্পর্কেও নিশ্চিত নন। এত বর্ণনাকারীর জ্ঞানের অসরতাই সুস্পষ্ট। তাহলে নবীজীর নাম করে এমন উদ্ভট কিচ্ছা প্রচারের যৌক্তিকতা কতটুকু পাঠক চিন্তা করুন। যদিও হযরত আবু তালিব যে ঈমানদার ছিলেন তার সপক্ষে অসংখ্য রেওয়ায়েত ও স্পষ্ট দলিলগুলো হাদীসে দ্বাহদ্বায় আরোপিত অন্যায় অপবাদের ভিত্তিহীনতাই প্রকাশ করেছে, তারপরও আরো বেশি স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে এখানে দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে হাদিস-এ ‘দ্বাহদ্বাহ’র পর্যালোচনা তুলে ধরা হল:
১। সনদগত ভিত্তিহীনতা।
২। আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের সঙ্গে এই (মিথ্যা) হাদিসটির বৈপরীত্য।

হাদীসে দ্বাহদ্বাহ’র সনদগত ভিত্তিহীনতা :
যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, হাদিসে দ্বাহদ্বাহ-এর বর্ণনাকারীরা হলেন যথাক্রমে: ‘সুফিয়ান ইবনে সাঈদ সুরী’, ‘আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর’, ‘আব্দুল আযিয ইবনে মুহাম্মাদ দেরাওয়ারদি’ এবং ‘লাইস ইবনে সাঈদ’।
আহলে সুন্নাতের রেজাল শাস্ত্রের পণ্ডিত ব্যক্তিত্বদের (যারা হাদিস বর্ণনাকারী রাবী ও মুহাদ্দিসদের সম্পর্কে আলোচনা করে থাকেন) দৃষ্টিতে হাদীসে দ্বাহদ্বাহ’র রাবীদের অবস্থান :
ক. সুফিয়ান ইবনে সাঈদ সুরী
আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে উসমান যাহাবী আহলে সুন্নাতের রেজাল শাস্ত্রের একজন প্রসিদ্ধ মনীষী। তিনি সুরী সম্পর্কে বলেছেন: “সুফিয়ান ইবনে সুরী জাল হাদিসগুলোকে দূর্বল রাবী থেকে বর্ণনা করত।”
উক্ত বাক্য থেকে স্পষ্ট যে, সুফিয়ান সুরীর বর্ণনাগুলো প্রতারণামূলক। আর দূর্বল রাবী এবং অপরিচিত ব্যক্তি থেকে হাদিস বর্ণনা করার কারণেই তার বর্ণনা করা সব রেওয়ায়েতই মূল্যহীন।
খ. আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর
যাহাবী তার সম্পর্কে বলেন, “অতি বৃদ্ধ হওয়াতে তার স্মৃতিশক্তি কমে গিয়েছিল।”
আবু হাতেম বলেন, “স্মৃতি-বিভ্রাটের কারণে হাদিস সংরক্ষণের শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল এবং তার মুখস্থ শক্তিও লোপ পেয়েছিল”।
আহমাদ ইবনে হাম্বাল বলেন, “আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর হলো দূর্বল দূর্বল (রাবীদের অন্যতম) এবং বহু ভুল করত (অর্থাৎ ভিত্তিহীন ও জাল রেওয়ায়েত বর্ণনা করত)”। ইবনে মুঈন বলেন, “সে সঠিক এবং ভুল হাদীসের মিশ্রণ ঘটাত।”
ইবনে খারাশ বলেন, “শো’বাহও তার ওপর সন্তুষ্ট ছিল না”।
কুসাজ, আহমাদ ইবনে হাম্বাল থেকে বর্ণনা করেন, আব্দুল মালেক ইবনে উমাইরকে (রেওয়ায়েত বর্ণনাকারী) অত্যন্ত দূর্বল ও যয়ীফ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।” উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর নিম্নলিখিত বৈশিষ্টগুলোর অধিকারী:
১. দূর্বল স্মৃতিশক্তি ও ভোলা মনের অধিকারী।
২. দূর্বল (রেজাল শাস্ত্রের দৃষ্টিতে) অর্থাৎ যে ব্যক্তির রেওয়ায়েতে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না।
৩. (তার রেওয়ায়েত) ভুলে পরিপূর্ণ।
৪. মিশ্রণকারী (যে ব্যক্তি সঠিক রেওয়ায়েতে সঙ্গে মিথ্যা রেওয়ায়েতের মিশ্রণ ঘটায়)।

এটা স্পষ্ট, যে সব বৈশিষ্ট্য আব্দুল মালেক ইবনে উমাইর সম্পর্কে উল্লিখিত হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটি তার হাদিসগুলোর ভিত্তিহীনতা প্রমাণে যথেষ্ট। আর ওই সব ত্রুটি সম্মিলিতভাবে তারই মাঝে বিদ্যমান ছিল।
গ. আব্দুল আযিয ইবনে মুহাম্মাদ দুরাওয়ারদি:
রেজাল শাস্ত্রে আহলে সুন্নাতের প-িতরা তাকে দূর্বল স্মৃতিশক্তি ও ভোলা মনের অধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন, “দুরাওয়ারদি’র স্মৃতিশক্তি এত দূর্বল যে তার রেওয়ায়েতের ওপর নির্ভর করা যায় না বা সেসবের সহায়তায় কোন যুক্তি প্রদর্শন করা সম্ভব নয়”।
আহমাদ ইবনে হাম্বাল ‘দুরাওয়ারদি’ সম্পর্কে বলেন, “যখনই সে তার স্মৃতিশক্তির সহায়তায় কোন রেওয়ায়েত বর্ণনা করত তখন তা অসংলগ্ন, অপ্রাসঙ্গিক ও বাতিল বা ভিত্তিহীন মনে হতো।”
আবু হাতেম তার সম্পর্কে বলেন, “তার কথার ওপর নির্ভর করা যায় না বা তার কথার স্বপক্ষে কোনরূপ যুক্তি প্রদর্শন করা সম্ভব নয়।”
ঘ. লাইস ইবনে সাঈদ :
আহলে সুন্নাতের রেজাল শাস্ত্রের গ্রন্থাবলী অধ্যয়নে এই বিষয়টি স্পষ্ট অনুধাবনীয় যে, যে সব রাবীর নাম ‘লাইস’ তারা সবাই অপরিচিত ও দূর্বল তথা যয়ীফ এবং তাদের হাদিসে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না।
আর লাইস ইবনে সাঈদও অন্যতম যয়ীফ ও বেপরোয়া এবং অমনোযোগী রাবী (বর্ণনাকারী) হাদিস শোনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অসাবধান (অর্থাৎ কি শুনতে হবে ও কি বর্ণনা করতে হবে সে বিষয়ে তিনি সুস্থির ছিলেন না)। আর যারা তার থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছে তারাও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন তার সম্পর্কে বলেন, “লাইস ইবনে সাঈদ যাদের কাছ থেকে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছে (তাদের চেনার ক্ষেত্রে) এবং হাদিস শোনার ক্ষেত্রে অসাবধান ছিল, অর্থাৎ কার কাছ থেকে এবং কোন বিষয়ের বা কোন ধরনের হাদিস বর্ণনা করতে হবে সে ব্যাপারে তিনি সাবধান ছিলেন না।”
‘নাবাতী’ তাকে দূর্বলদের অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজ গ্রন্থ ‘আত্ তাযলীল আলাল কামেল’-এ তার (লাইস ইবনে সাঈদ) নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি এ বইটি শুধু দূর্বল রাবীদের পরিচয় তুলে ধরার জন্যই লিখেছেন ।
এ পর্যন্ত যা কিছু বলা হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ‘হাদীসে দ্বাহদ্বাহ’-এর প্রধান বা মূল রাবীরাই ছিলেন যয়ীফ তথা দূর্বল। আর এ কারণেই তাদের হাদিসে বিশ্বাস করা যায় না।

হাদীসে দ্বাহ্দ্বাহ্ কোরআন ও সুন্নাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় :
উল্লিখিত হাদিসটিকে রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে এভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে যে, তিনি হযরত আবু তালিবকে দোযখের বৃহৎ অগ্নিকু- বা ব্যাপক আগুনের স্তর থেকে বের করে কম আগুনের একটি গর্তে স্থানান্তরিত করলেন। আর এভাবে তার আযাবে হ্রাস ঘটানো হলো। অথবা কেয়ামতের দিন তাকে শাফায়াত করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। অথচ পবিত্র কোরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত একমাত্র মু’মিন ও মোত্তাকী মুসলমানদের জন্যই শাস্তি হ্রাস ও শাফায়াতের বিষয়টিকে সমর্থন করে। অতএব, যদি আবু তালিব ‘কাফের’ হয়ে থাকে তবে আল্লাহর রাসূল (সা.) কখনই তার আযাব কমাতে অথবা তাকে ‘শাফায়াত’ করতে সক্ষম নন। কারণ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে কাফেরদের বিষয়ে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, শাফায়াত নয়।

এভাবেই ‘হাদিসে দ্বাহদ্বাহ’-এর বক্তব্য বা বিষয়বস্তুর ভিত্তিহীনতা ও যারা হযরত আবু তালিবকে কাফের জ্ঞান করেন তাদের দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া উক্ত হাদীসের সহীত পবিত্র কোরআনের কোন সম্পৃক্ততা নেই, উপরন্ত সাংঘর্ষিক। যেমন মহান আল্লাহপাক এমন নন যে, কারো সৎ কাজের বিনিময়ে তাঁকে জাহান্নামে প্রেরন করবেন। হযরত আবু তালিব নবী (সা.)-এর লালন-পালন ও হেফাজত করে ইসলমের মূল ভীত রচনায়, সৎকাজের যে অপরীশোধিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার বিনিময়ে এ পুরস্কার দ্বাহদ্বাহ? (নাউজুবিল্লাহ) পাঠক বিবেচনা করুন।

বনী উমাইয়া শাসকদের দরবারে রচিত হাদীসের আলোকে মুসলমান আজ নানা মত ও পথে দ্বিধা বিভক্ত। যে কারনে দ্বীন ইসলামের পৃষ্ঠপোষক হযরত আবু তালেবকে কাফের আখ্যা দিতে ঐ সকল মুসলমানের আকল জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনার কোনো উন্মেস ঘটেনি। নি¤েœ আমি মহানবী (সা.)-এর দুজন বিখ্যাত সহাবীর উদৃতি তুলে ধরছি।

হযরত আবু বকর থেকে বর্ণিত তিনি বলেন হযরত আবু তালিব ইন্তেকালের সময় পাঠ করেছেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূল্লাহ” অথ্যাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নাই, মোহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।
হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত আবু তালিব ইন্তেকালের পূর্বে বলেছেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মহাম্মাদুর রাসূল্লাহ” অথ্যাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নাই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।”

Title ইসলামে হযরত আবু তালিবের অবদান
Author
Editor
Publisher
Number of Pages 96
Country বাংলাদেশ
Language বাংলা

No review available yet.

'